প্রফেসর মোঃ আব্দুল আউয়াল মিয়া-এর বাণী
সবুজের পললচাদরে মোড়া ইছামতি নদীর তীরে যেন নিঃশব্দ এক উপাখ্যান লিখে চলেছে পাবনার হৃদয়ে অবস্থিত সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ—বাংলাদেশের শিক্ষা-ভুবনের এক দীপ্ত নক্ষত্র। এই প্রতিষ্ঠান কেবল একটি শিক্ষাঙ্গন নয়, এটি যেন ইতিহাসের ছায়ায় গড়ে ওঠা এক সোনার গৌরবতোরণ, যার প্রতিটি ইটের গায়ে লেখা আছে শিক্ষার, সাহিত্যের, সংস্কৃতির ও সংগ্রামের অনন্ত গাঁথা।
১৮৯৮ সালে ৪৯ একর বিশাল পরিসরে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠ আজ স্নেহময় মাতৃস্বরূপে ২৬ হাজার শিক্ষার্থীর জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাচ্ছে। এখানে ১৭টি বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স ও ডিগ্রি কোর্স চালু রয়েছে—প্রতিটি বিভাগ যেন একটি স্বতন্ত্র নদী, যার স্রোত বইছে জ্ঞান ও সৃজনশীলতার পরিপূর্ণ দিগন্তে। ২০১৮ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে প্রতিষ্ঠানটি তার মহিমা ছড়িয়ে দেয় সারাদেশে, যেন জ্ঞানের আকাশে এক দীপ্ত জ্যোতিষ্ক৷
এই গৌরবের মালা কেবল সংখ্যার নয়, তা এক আবেগময় অভিযাত্রার ইতিহাস। কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীরা স্থানীয় থেকে শুরু করে জাতীয় মঞ্চেও ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদের প্রতিভার দীপ্ত আলো। এই প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্ভূত লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী কালের ক্যানভাসে তাঁদের সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তির দীপ্ত ছাপ রেখে গেছেন—অর্থনীতি, রাজনীতি, ক্রীড়া, সাহিত্য ও সংস্কৃতির আকাশে তাঁরা হয়েছেন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো অমলিন।
প্রতিবছর উচ্চ মাধ্যমিকের গৌরবোজ্জ্বল সন্তানরা দেশের খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে যে রেকর্ড গড়ে, তা যেন এক গোপন রত্নভান্ডার খুলে দেয় দেশের আগামী ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দুয়ারে। পাঠ্যসূচির গণ্ডি ছাড়িয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতি কেন্দ্র—যেখানে শব্দ হয়ে ওঠে বর্ণের ফুলঝুরি, আর কবিতা এক মহাজাগতিক ছন্দের প্রতিধ্বনি। প্রযুক্তির দীপ্তির সাথে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠেছে সাইবার সেন্টার, আর বিশ্বদরবারে পা রাখার মতো করে গড়ে তোলা হয়েছে ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার—যেখানে শিক্ষার্থীরা পাঁচটি বিদেশি ভাষার বুননে গাঁথছে তাদের স্বপ্নের ডানার পালক। আজকের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায়, আগামীর বাংলাদেশের রূপকার হবার পথে এডওয়ার্ড কলেজ যেন এক দীপ্ত মশালবাহী পথিক।
মানবিক মূল্যবোধ ও সহমর্মিতার বীজ রোপণ করতে কলেজে সক্রিয় রয়েছে রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, যুব রেড ক্রিসেন্ট এবং বাঁধন ইউনিট। এইসব সংগঠন যেন শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে জ্বেলে দেয় এক আলোর প্রদীপ, যেখানে সেবা মানে আত্মপ্রকাশের শ্রেষ্ঠ আনন্দ।
“জুলাই ২৪” এর অভ্যুত্থানের চেতনা এই বিদ্যাপীঠের অন্তর-অঙ্গনে পাথরের মতো খোদাই করা— একটি উদার,মানবিক, বৈষম্যহীন ও ইনসাফভিত্তিক বাংলাদেশের প্রতীক হয়ে এই কলেজ দাঁড়িয়ে আছে সময়ের সংবেদী প্রান্তরে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেন এখানে শুধু বইয়ের পাতায় বন্দি নয়, বরং শিরায় শিরায় প্রবাহিত রক্তের মতো জাগ্রত। শহীদ আবু সাইদ, মুগ্ধ,জাহিদ, নিলয়সহ অসংখ্য দেশপ্রেমিকের শাহাদাত এবং অগণিত মুক্তিকামী তরুণের অংগহানি নতুন করে আমাদের শপথবদ্ধ করেছে দেশবিরোধী যে কোনো চক্রান্ত রুখে দিতে। স্বাধীনতার সুফল সতেরো কোটি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এই প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নির্মিত হয়েছে আধুনিক শহীদ মিনার ও অনন্য স্বাধীনতা স্তম্ভ, যা দাঁড়িয়ে আছে যেন এক চিরকালীন শপথের অনুরণন হয়ে ।
রবীন্দ্র সংগীতের নুপুরধ্বনি, নজরুল সংগীতের ঝঞ্ঝা-বাতাস, দেশাত্মবোধক গানের উজ্জ্বলতা, কবিতা আবৃত্তির করুণ রাগিনী, নৃত্যের ঝলক, লোকগানের পল্লব, বক্তৃতার দীপ্ত চরণ ও নাট্যাভিনয়ের মঞ্চ—সবই এখানে একে অপরের আলিঙ্গনে কলেজকে করে তুলেছে এক প্রাণন্ত সুরের তরঙ্গে ভাসমান স্বপ্নলোকে।
শিক্ষার্থীদের সহজে ইন্টারনেট সুবিধা দিতে পুরো কলেজ এলাকাকে আনা হয়েছে Wi-Fi নেটওয়ার্কের আওতায় । উন্নয়নের এই মহাযজ্ঞে গড়ে উঠছে নতুন অবকাঠামো, আধুনিক মসজিদ, সুসজ্জিত ক্যাম্পাস ও বৃক্ষরোপণের সবুজ শপথ—সব মিলে যেন এক মহাকাব্যিক স্বপ্নের বাস্তব রূপ।
কলেজের ওয়েবসাইট থেকে নতুন শিক্ষার্থীরা যেন জেনে নিতে পারে জীবনের অর্থ , ভবিষ্যতের পথ ও আত্মার আহ্বান, তাদের সোনালি ভবিষ্যৎ গড়ে উঠুক এই বিদ্যাপীঠের আদর্শে—তারা হয়ে উঠুক আগামী দিনের শ্রেষ্ঠ মানুষ, জাতির যোগ্যতম কর্ণধার।
পরিশেষে বলতে চাই , সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ আমাদের কাছে শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি আমাদের যৌবনের স্বপ্নখচিত আঙিনা, যেখানে কাঁচা চোখে ভবিষ্যতের রঙ আঁকে হাজারো তরুণ হৃদয়। এখানে প্রতিটি সকাল শুরু হয় আলোর প্রতিজ্ঞায়, আর প্রতিটি বিকেল বিদায় নেয় শ্রদ্ধার প্রতিধ্বনিতে। ইতিহাসের মাটি আর স্বপ্নের আকাশে দাঁড়িয়ে এই বিদ্যাপীঠ গড়ে তুলবে মানুষের আদর্শ প্রতিচ্ছবি—যারা শুধু ডিগ্রি অর্জন করবে না, বরং অর্জন করবে মনুষ্যত্বের দীপ্ত চিহ্ন। তারা হয়ে উঠবে একেকটি আলোকবর্তিকা, যারা আঁধার চিরে উদ্ভাসিত করবে একটি সুন্দর সোনালী আগামীকাল।