ইতিহাস
অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলার উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে আধুনিক শিক্ষা বিষয়ক ঐতিহাসিক নীতিমালা আশ্রয় করে কলেজস্তরের শিক্ষা প্রসারে সম্ভাবনার সৃষ্টি করে।পাবনার জেলাবাসীর প্রতীক্ষার কাল খুব বেশি দীর্ঘ হয় নি,ঐ শতকেরই শেষে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে এ জেলা শহরে কলেজ প্রতিষ্ঠার দীপ্তিময় ইতিহাস রচিত হয়।স্বাধীন বাংলার সীমানায় তখনও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাবোর্ড গড়ে ওঠেনি,উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকায় রাজশাহী কলেজ ছারা আর কোনো কলেজ ছিলনা।
কলেজ প্রতিষ্ঠার এই প্রোজ্জ্বল প্রেক্ষাপটে একজন মানুষের নাম উচ্চারন করতেই হয়,যে মানুষটির উৎসাহে ও দৃঢ় প্রত্যয়ে পাবনার নতুন প্রজন্মের সাথে আধুনিক শিক্ষার সময়োচিত সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়েছিল –তিনি হলেন শ্রী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী। পদ্মা যমুনার বিধৌত পলিমাটিতে ইতোমধ্যে (১৮২৮খ্রি.) জেলার ভৌগোলিক সীমানা চিহ্নিত হয়ে যাওয়া পাবনা নামের ভূখন্ডের জেলা শহরে ১৮৯৮খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে শ্রী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী তারই প্রতিষ্ঠিত ‘পাবনা ইনস্টিটিউশন বিদ্যালয় (প্রতিষ্ঠিত ১৮৯৪ খ্রি.,বর্তমানের গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউট)-এর একটি কক্ষে নতুন কলেজের দ্বারোদ্ঘাটন করলেন এবং প্রধান শিক্ষকতার সাথে অধ্যক্ষের দায়িত্বেও সমাসীন হলেন।
সে বছরেরই ডিসেম্বরে F.A Standard কলেজ হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তিলাভের মধ্য দিয়ে তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়ন হলো।তিনি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ প্রর্যন্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন।এ বছর কলেজটির নামকরন করা হয় “পাবনা কলেজ”।১৯১১ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্মৃতি রক্ষার্থে কলেজটির নামকরন করা হলো ‘এডওয়ার্ড কলেজ’।প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মহোদয়ের দায়িত্বকালীন সুযোগ্য সহকর্র্মী ছিলেন শ্রী গোপাল চন্দ্র মৈত্র,শ্রী আশুতোষ রায়,পন্ডিত হরি নারায়ণ কাব্যর্তীথ বিদ্যাবিনোদ এবং মৌলভি সিরাজ-উল হক প্রমুখ অসাধারণ মানুষ সুনামের সাতে অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন।
পাঠদানের বিষয়গুলো ছিল ইংরেজি,ইতিহাস,যুক্তিবিদ্যা,গনিত,বিজ্ঞান,সংস্কৃত,আরবি ও ফারসি।কলেজটিকে আশ্রয় করে নতুন শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে ওঠে,শিক্ষার প্রসার হয়,সংস্কৃতির বহুবিস্তার ঘটে,জিজ্ঞাসার অসীমতা সৃষ্টি হয়।এ কলেজকে কেন্দ্র করে বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির দীপ্ত আঙ্গনে পাবনা জেলার স্থান স্বর্ণময় হয়।১৯১২খ্রিস্টাব্দের আগস্টে তাড়াশের জমিদার রায় বাহাদুর বনমালী রায় কলেজকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দানের ঘোষনাসহ কলেজ পরিদর্শনে আসা বাংলার গভর্নর লর্ড টমাস ডেবিড ব্যারন কারমাইকেলকে স্বাগত সম্ভাষন জানান।এঅনুষ্ঠানে গভর্নরও সমপরিমান টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দেন।এ বছরেই অধ্যক্ষের চলতি দায়িত্ব পান পাবনার কৃতি সন্তান অসাধারন প্রতিভাবান অধ্যাপক ও কবি হেমচন্দ্র রায়।
এডওয়ার্ড কলেজের নিজস্ব ভবন ও জায়গা-জমি হতে প্রায় ১৭/১৮বছর লেগেছে।তবে ২৫ বছর পূর্তির আগেই নিজস্ব জায়গা-জমি,অট্রালিকা আর পাঠদানের সুনাম দ্বারা ব্রিটিশ বাংলার একটি আদর্শ কলেজে উন্নীত হয়।অসাধ্য সাধনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহসের কিছু প্রোজ্জ্বল স্মারক হিসাবে স্মর্তব্য যে,১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কুষ্টিয়ার আমলা সদরপুরের জমিদার প্যারীসুন্দরী দাসীর উত্তরাধিকারী গোপী সুন্দরী দাসী ও দেবেন্দ্র নারায়ণ সিংহ সাড়ে ৪৬ বিঘা জমি দান করেন।এ সময়ে বিভিন্ন এলাকার বিদ্যানুরাগী জমিদারগণ কলেজের জন্য উদার হস্তে অর্থ দান করেন।
১৯১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই লক্ষাধিক টাকায় কলেজের অট্রালিকা নির্মানের প্রাথমিক কাজ হয়ে যায়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সপ্তম অধিবেশনে যোগদান করতে এ কলেজে আসেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়,‘ভারতবর্ষ ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন,ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্র,নলিনী রঞ্জন পন্ডিত,রাধারমন সাহা,সাহিত্যিক ও সমাজ সেবক গুরুসদয় দত্ত (আইসিএস), ‘স্বরাজ’ পত্রিকার সম্পাদক কিশোরী মোহন রায়,এ কলেজের অধ্যক্ষ গোপালচন্দ্র লাহিড়ী,পাবনার জমিদার শশধর রায়,শিতলাইয়ের জমিদার যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র প্রমুখ প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গ।১৯২১ খ্রিস্টাব্দে Up to Intermediate Science Standard কলেজ হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি ও ৫টি বিষয়ে পাঠদানের অনুমতি পাওয়া যায়।আগে থেকেই ওহঃবৎসবফরধঃব-এর পরের বছরে বিএসসি ভবন নির্মানের পর ১৯২৫খ্রিস্টাব্দে বিএসসি কোর্স চালু হয়।
এর পর ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে বিএ কোর্স এবং ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে বায়োলজি বিভাগ খোলা হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ও ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে অর্থনীতিতে অনার্স কোর্স চালু হয়।১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে কলেজ সংলগ্ন জমি অধিগ্রহনের ফলে মোট জমির পরিমান হয় ৪৯ একর এবং পৃথক ডিগ্রি ভবনসহ ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কাজের ভিত্তি স্থাপিত হয় নতুন জমিতে।১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ১ মার্চ থেকে কলেজটি প্রাদেশিকীকরণের ফলে সরকারি হয়ে যায়।১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে পদার্থ বিজ্ঞান,গনিত ও ব্যবস্থাপনায় অনার্স কোর্স চালু হয়।বাংলা ও অর্থনীতিতে এমএ কোর্স শুরু হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৭৮খ্রিস্টাব্দে এ কলেজ ‘৩৫টি সরকারি কলেজ উন্নয়ন প্রকল্পভুক্ত’ হয়।এ প্রকল্পাধীনে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হয়।১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে কলেজটি ‘আটটি বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়।এবং ২৯৮.৮৪ লক্ষ টাকায় ১৯৮৭-৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলেজের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ হয়।১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজী ,রসায়ন,উদ্ভিদবিজ্ঞান,হিসাববিজ্ঞান,রাষ্টবিজ্ঞান,দর্শন,ও ইতিহাস বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়।এতে অনার্স কোর্স চালু বিষয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২টিতে।
১৯৯৫খ্রিস্টাব্দে এ ১২টি বিষয়েই মাস্টার্স কোর্স চালু হয়।১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে পাঠদান শুরু হয়।এর পরের বছর প্রাণিবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স শুরু হয়।২০১১ খ্রিস্টাব্দে মার্কেটিং ও ফিন্যান্স বিষয়ে অনার্স কোর্সে পাঠদান শুরু হয়েছে। ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষার্বষ থেকে মাধ্যমিক শ্রেণি বন্ধ কওে দেয়া হয়।২০১৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে শিক্ষা মন্ত্রাণালয় পুনরায় এ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট কোর্স খোলার জন্য নির্দেশ দেয় এবং এর পেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড,রাজশাহী,উচ্চ মাধ্যমিক শাখা খোলার প্রয়োজনীয় অনুমতি প্রদান করে।ফলে ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান,মানবিক ও ব্যবসা শিক্ষা শাখা মোট ৬০০ জন ছাত্র ছাত্রী ভর্তি করার মধ্য দিয়ে পুনরায় উচ্চ মাধ্যমিক পাঠদান শুরু হয়।বর্তমানে এ কলেজে ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার । বিশ শতকের গোধূলি বেলায় এডওয়ার্ড কলেজ শতবর্ষের গৌরবদীপ্ত পথ পরিক্রমা সম্পন্ন করে।
একুশ শতকের সুপ্রভাত কলেজটির জন্য জাতীয়পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে পুরস্কৃত হওয়ার শুভবার্তা বয়ে এনেছে এবং সরকারি কলেজগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ A+ ক্যাটাগরিভুক্ত হয়েছে এডওয়ার্ড কলেজ।২০১০-২০১১ অর্থবছরে জেলা শহরে অবস্থিত ৬৯টি সরকারি কলেজ উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৪তলা বিশিষ্ট একাডেমিক কাম এক্সামিনেশন সেন্টার এর নির্মান কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।কলেজের বিভিন্ন বিভাগে সর্বমোট ১৬০টি পদ সৃষ্টি হয়েছে এবং আরো কিছু পদ সৃষ্টির কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।বর্তমানে কলেজে একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনসহ দুইটি ছাত্রীনিবাস ও তিনটি ছাত্রাবাস ,একটি ক্যাফেটেরিয়া,আধুনিক বিজ্ঞানাগার,কয়েকটি খেলার মাঠ,লাইব্রেরি,অডিটোরিয়াম এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্থাপনা বিদ্যমান।বর্তমানে কলেজের আর্থিক লেনদেন On line-এ হচ্ছে এবং সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও D-alart চালুর প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। ভারত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড, মহামহিমান্বিত রাজ রাজেশ্বর ভারত-সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড।
তাঁর মাতা রাণী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।রাজ্যাভিষেককালে তিনি ‘গ্রেডব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ড এবং ব্রিটিশ উপনিবেশ সমূহের রাজা,ধর্মের রক্ষক এবং ভারতবর্ষের সম্রাট উপাধি গ্রহন করেন।সপ্তম এডওয়ার্ড দয়ালু ,প্রজাবৎসল,বিচক্ষণ,অমায়িক ‘শান্তি-সংস্থাপক’ হিসাবে স্বরনীয় হয়ে আছেন।তার শাসনামলের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্টে ‘শিক্ষা আইন’ প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষা পদ্ধতির আধুনিকীকরন করা।১৯১০ খিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের ধর্মপরায়ণ ও পরমতসহিষ্ণু সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের মৃত্যু হলে তার পুণ্যস্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে ১৯১১ খিস্টাব্দের আগস্ট মাসে পাবনা কলেজের নামকরন করা হলো ‘ এডওযার্ড কলেজ ’।একজন সম্রাট নামে কলেজের নামকরন উপমহাদেশে এটিই প্রথম ।